Saturday, August 5, 2017

রিপন সাহা'র নির্ঘুম স্বপ্ন সাম্রাজ্য


পলাশ ভট্টাচার্য্য
Publication:  'The Empire of Dream' Ripon Saha's solo exhibition Catalogue, Kalakendra, Dhaka.

নির্ঘুম স্বপ্ন সাম্রাজ্য- রঙ বেরঙের স্থির আর অস্থির দৃশ্য। প্রতিটি দৃশ্য আর দৃশ্যগুচ্ছের আমেজ কখনো উৎসবে অথবা আয়েশে, কখনো বিদ্রুপে অথবা কটাক্ষে আর কখনো সংঘাতে কিংবা নৈরাজ্যে। এইসব নির্ঘুম স্বপ্নকল্পে ছুটে বেড়ানোর সমূহ চিত্র নিয়ে রিপন সাহার এবারের প্রকল্প The Empire of Dream.

রিপনের শৈশব হতে আজ অব্দি বেড়ে ওঠা চট্টগ্রামের হাজারী লেন সংলগ্ন এলাকায়। যার আশপাশটা জুড়ে রয়েছে থানা, কোর্ট, স্কুল, হোটেল, ময়দান, মার্কেট, সিনেমা হল থেকে শুরু করে ধর্মীয় উপাসনালয়। আর খুব কাছেই বয়ে গেছে কর্ণফুলী নদী। এলাকাকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় যেসব ঘটনা- তা উৎসব থেকে শুরু করে সংঘর্ষ পর্যন্ত বিস্তৃত। এসব ঘটনার সাথে যাদের সম্পর্ক , রিপন তাদের কখনো দেখেছে দূর থেকে আবার কখনো খুব কাছ থেকেই চিনেছে। এই বেড়ে ওঠার বিচিত্র সব অভিজ্ঞতার সঞ্চয়গুলো জারিত হয়ে ভিন্ন কোন জগতের ব্যাপকতায় বিচরণ রিপনের। শৃংখলার বাইরে ছিটকে স্থানিক, বৈশ্বিক এবং সার্বজনীনতার স্বতস্ফুর্ত সম্পর্ক গড়ে ওঠে কখনো সামজিক জমকালো উৎসবের সাথে, কখনো বিবর্ণ বিক্ষিপ্ত নৈরাজ্যের সাথে, আবার কখনো প্রকৃতির সাথে।

রিপনের স্বপ্ন যে নৈরাজ্যে পর্যবসিত হয়, সেখানে রয়েছে একদিকে তীব্র হানাহানি, আরেকদিকে বিদ্রুপ আর কটাক্ষের স্নায়বিক উত্তেজনা। এসব হানাহানির ভেতর জায়গা করে নিয়েছে স্থানীয় রূপকথা, মিথ আর জনপ্রিয় প্রবাদ। এই উত্তেজনার রাজনৈতিক অথবা মতাদর্শিক কোনো পর্যায়ে সমাধান নেই। আছে নানা পর্যায়ের ক্ষমতার দৃষ্টান্ত যেখানে সাংঘর্ষিক মৃত্যুর  চেয়েও রয়েছে শক্তির চমক । নীৎশের মতে যেমনটা That which does not kill us makes us stronger.    রিপন এই ক্ষীপ্রতার বিন্যাসে বের করে আনে কালো লালে'র আধিক্যে ছোট ছোট ক্যানভাসের একগুচ্ছ চিত্র যেখানে উঠে আসে সংঘর্ষের সংস্কৃতি।

অর্থনৈতিক মানদন্ডের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা ক্ষমতাকে নিয়ে  চটুল সেসব শ্রেণীকে বার বার উপস্থাপন করা হয়েছে বিদ্রুপ আর কটাক্ষের অভিনব আঙ্গিকে। যেখানে অনেক চিত্রে ঘুরে ফিরে মানব দেহের গঠন হয়ে উঠেছে আঙ্গুল সর্বস্ব। আঙ্গুলের নির্দেশ, আঙ্গুলের ভঙ্গিগুলো যেন ক্ষমতার উত্থানের অনুমাপক। তাছাড়া জমকালো সামাজিক উৎসব নিয়েও বাহাস করার প্রবণতা দেখা যায় গুচ্ছ গুচ্ছ আলোচ্ছ্বটায় কোলাহলমুখর শহরের চমক সৃষ্টি করা চিত্রগুলোতে।

এই সমসÍ উদবেগের ভেতর রিপনের ফ্যান্টাসি লক্ষ্য করা যায় প্রকৃতির সাথে কৌতুকাবহে গড়ে ওঠা তার ব্যক্তিগত সম্পর্কে। নদীতে ভাসানো অংক খাতার কাগজের নৌকায় বাঘের সাথে সাক্ষাত কিংবা টুকরো টুকরো সাদা ভাসমান মেঘের সাথে নিত্য ব্যবহৃত সাধারণ কোন বস্তুর উপস্থিতিতে গড়ে ওঠা সিনেমাটিক ফ্যান্টাসি যা জাগতিক অভিজ্ঞানের ভেতর অবদমিত প্রতিচ্ছবি। এছাড়া হিসেবের খাতার নৌকা যেন একেবারেই মানুষে মানুষে পরিপূর্ণ, কেউ কেউ নদীতে ঝাঁপিয়ে বা ডুবসাঁতার দিয়ে পাড়ি দিচ্ছে কোথাও। স্থানচ্যুত মানবগোষ্ঠী কোন অজানায় পাড়ি দিয়ে যাচ্ছে- যা গোটা বিশ্বের রাজনৈতিক ক্ষমতার সৃষ্টি এক কৃত্রিম সঙ্কটের প্রতি ইংগিত প্রকাশ করেছে রিপন।

ইতিপূর্বে রিপনের একক প্রদর্শনীর শিল্পকর্মগুলোতে স্টেন্সিল আর স্প্রে কালারের ফিগারিটিভ বিন্যাস লক্ষ্য করা গেলেও এ পর্যায়ে স্টেন্সিলের ব্যবহার তেমন নেই বললেই চলে। এখানে রয়েছে ফিগারেটিভ ফর্ম, রেখা আর রঙের আধিক্য। মানব আকারের কখনো ঘটেছে বিকার কিংবা রূপান্তরিত আকার- যেমন আঙ্গুল সর্বস্বতা এ পর্যায়ের একটি প্রধান মেটাফরিক উপাদান। উপকরণের মধ্যে রয়েছে এক্রেলিক পেন, এক্রেলিক কালারস্প্রে কালার, প্রেস ইংক প্রভৃতির ব্যবহার। পাশাপাশি রয়েছে কিছু এনিমেটেড ভিডিও চিত্র। ম্যানুয়াল আর ডিজিটাল উভয় প্রক্রিয়ায় নির্মিত ভিডিওগুলোতেও রয়েছে সংঘর্ষের সংস্কৃতি তথা অস্ত্র, রক্তপাত আর এর উৎসের বিপন্ন ইতিহাসের বিনির্মাণ।

রিপনের শিল্পচর্চার এ যাত্রা শুধু কৌশলগত দক্ষতার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। এই পরিক্রমণ  বুদ্ধিবৃত্তিক এবং ব্যক্তিগত জীবনযাপনের অভিজ্ঞতাগুলো তাকে নতুন পথের সন্ধানে অণুপ্রাণিত করে। তাই এই পথ হয়তো শুধু রাজনীতির কবলে আক্রান্ত নয়, তার চারপাশটায় আরো কিছু সংযোজন আর বিয়োজনের ভেতর ঘুরপাক খেতে থাকে অনেক কাল থেকে। এর ভেতরেই অভিজ্ঞতার বিনির্মাণ ঘটতে থাকে আর আত্মোপলব্ধি হতে থাকে জীবনভর। পাওলো ফ্রেইরির একটি কথা দিয়েই ইতি টানা যায় এ পর্যায়ে- No one is born fully-formed: it is through self-experience in the world that we become what we are.        


Sunday, December 4, 2016

অপু ধরের একক প্রদর্শণী

পলাশ ভট্টাচার্য্য
Report for Depart Magazine

রাত শেষের স্বপ্নে পাওয়া কয়েকগুচ্ছ দৃশ্য বিশেষ। কিছু কীট-পতঙ্গের স্থবির বসবাস বিছানার চারপাশ। বিছানা থাকলেও দেহখানি নেই, বোধ হয় স্বপ্নের ভেতর হারিয়ে গেছে নিরীহ দেহটি।  অস্পষ্ট আলোয় কীটের দেখা মিললেও দেহের দেখা নেই। আলো-আধারিতে পাতানো বিছানার কাছে যদি কেউ এগুতে যান, হোঁচট খেয়েও পড়তে পারেন। একটু বোধ হয় সতর্কতা জারি করে দেয়  অবোধ নিথর আকারের কীটকুল। এ দেহটির অনুপস্থিতি হয়তো তার নিজের স্বপ্ন দেখাতে চাইছে আমাদের, যাতে কীট-পতঙ্গের পাহারায় আমরাও দেহটির স্বপ্নের সাথে মিশে যায়। বিছানার একপ্রান্তে ভিডিও প্রজেকশনে ভেসে উঠে ইট কাঠ পাথরের দালান কোঠার পাশাপাশি পুকুর আর সবুজ বনানী। বিছানার আরেক প্রান্তের ভিডিওতে সেই অদৃশ্য দেহটির দৃশ্যমান অবয়ব নড়েচড়ে ওঠে। দেহটির মুখাবয়বের নানা ভংগিমা- নিদ্রা, আলস্য, কামনা, অভিমান, অতৃপ্তি, ধৈর্য যেন পালটে দেয় রঙ। তার সাথে পিপড়া সহ কীটের দল তাদের অকেজো অংগ প্রত্যংগ ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখে এই ভিডিও দৃশ্য কল্পে। অদৃশ্য দেহটি ছিল অপু ধরের। তবে দৃশ্যমান হয়ে ওঠে অপুর দেহটি তার অবদমিত মনোভাবের এইসব  সমূহ ভিডিও চিত্রায়ণে। আলো আধাঁরির এমন আয়োজনে অপুকে চিনে নিতে অসুবিধে হয় না। বিছানায় যার অনুপস্থিতি সে ঘুরে ফিরে বার বার ভিডিওগুলোতে ভেসে ওঠে জানান দেয় যে বিছানাটি ছিল তারই।

মধ্যরাত পরবর্তী এমন স্বপ্নময় দৃশ্যাবলীর সমন্বয় ঘটেছিল Alliance Française de Chittagong এ 26th October  - 29th October 2016. এটিই ছিল অপুর প্রথম একক প্রদর্শণী। সম্প্রতি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইন্সটিটিউটের ভাস্কর্য বিভাগ থেকে লেখাপড়া শেষ করে শিল্পচর্চা চালিয়ে যাচ্ছেন বিভিন্ন মাধ্যমগত নিরীক্ষায়। যার মধ্যে এই প্রদর্শণীতে শরীরভিত্তিক শিল্পমাধ্যম বা পারফরমেন্সের ভিডিওর সাথে ভাস্কর্যের সংযোগে অপু তার স্বপ্ন, উদবেগ, উত্তেজনার সমন্বয়ে এক রহস্যময় দৃশ্যকল্প নির্মাণ করেছেন।

 কিছুটা ব্যক্তিগত শয়ণ কক্ষের আদলে গ্যালারীতে শিল্পকর্ম স্থাপনা করা হয়েছিলো। যেমন কক্ষের একপাশে  একটা ছোট টেবিল আর চেয়ার বসানো আছে আর টেবিলের উপর মনিটরে সিংগেল চ্যনেল ভিডিও স্থাপন করা হয়। যেখানে অপুকে দেখা যায় এক হাতে আপেল খাওয়া আরেক  হাতে মুট ধরে রাখে  সরলরৈখিকভাবে দুপাশে জলন্ত মোমবাতির মাঝখানটায়। এই পারফরমেনসে অপুর শরীর তীব্র মনোযোগী হয়ে ওঠে আপেল খাওয়ার মাদকতায়। পাশাপাশি গলে গলে মোমবাতির ক্ষরণ সময়কে এগিয়ে নিয়ে যায়।আর আপেলটাও যেন একেকটা দরদী(!) কামড়ে শেষ হয়ে আসে।  অবচেতন আর অবদমনের যে সব পরিস্থিতিকে আমরা স্বীকার করতে এবং স্বীকৃতি দিতে আমাদের চলতি বাস্তবতায় অক্ষম- তাকেই অপু এমন কার্যক্রমের  ভেতর তুলে আনেন এই ভিডিওতে। এছাড়া গ্যালারীর একপ্রান্তে জানালার খোপে আরেকটি পারফরমেন্স ভিডিও ইন্সটল করা হয়। ভিডিওটিতে সাদা আর লালে আবৃত দুটি দেহ ছোট্ট একটি গেরোর সংযোগে ফ্লোরে আঁকিবুঁকি করে করেই চলে। আঁকিবুঁকির পরিমাণ বাড়তে থাকে গ্যালারীর ফ্লোর জুড়ে।

অপুর স্পেসের সমন্বয় ছিলো প্রদর্শণীর উপকরণগুলোতে। মেটালের তৈরী পিপড়ে আর পোকামাকড়ের বিস্তার ছিলো গ্যালারীর মধ্যবর্তী স্পেসে। আলোক স্বল্পতা এবং খালি স্পেসের বন্টন এই প্রদর্শণীর জন্য ছিলো চ্যালেঞ্জিং । আর এই দুটো চ্যালঞ্জিং অংশ অপুর ভিডিওগুলো এবং শিল্পবস্তু গুলোর উপস্থাপণে সম্পূর্ণতা নিয়ে আসে পুরো প্রদর্শণীতে। পরিশেষে, অপুর এই প্রচেষ্টা নতুন কোনো শিল্পভাষার সন্ধান পাবে যেখানে তার ব্যক্তিগত থেকে স্থানিক আর পারিপার্শ্বিক চেতনার ব্যাপক প্রতিফলন ঘটবে।

Monday, August 8, 2016

শিল্প বিনির্মাণ এবং বাহরাম


পলাশ ভট্টাচার্য্য
Publication: 
http://www.banglanews24.com/art-literature/news/bd/508400.details
দুটো চোখ নিস্পলক। চোখ দুটির একটি আবার গরুর। আস্ত মানব প্রতিকৃতিতে আস্ত একটা গরু জায়গা করে নিলো। গরুটা ছিলো বলেই তো মনুষ্য চেহারাখানার আকার এলো। তারপর গলার কাছে  একটা হাত চেপে রাখা, ওটা গলাটিপে ধরার মত কিছু না, ওটা মোলায়েম ভাবে চেপে রাখা একটা হাত ওটা চেপে না ধরলে হয়তো একেক দিকে ছিটকে পড়বে অভাগা গরু আর মানুষটি। তখন  প্রতিকৃতিটি ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবার ঝুঁকি থেকে যাবে। কপাল ভালো সামঞ্জস্যের হাত খানা গলার কাছে ছিলো। না হলে যে কি হত!

কি আর হতো! যে যার রাস্তায় ছিল সেখানেই পড়ে থাকতো। বাহরাম এই জগতকে মিশিয়ে দিলেন উদ্ভট এক চেতনায়। লজিকের বাঁধা রাস্তা থেকে বিচ্যুত বাহরাম। এই জগত অবিশ্বাস্য কোনো  এক চেতনার ভেতর মিশে যেতে না যেতেই আবার সেই চেনা রাস্তাগুলো ফের উঁকি মারতে করে শুরু করে দেয়। তখন মনে হয় এই বুঝি সেই। এমনটা না হলেই কি নয়! শিবপুরাণে যে শনির দশায় গণেশের মাথাটা হাতির মাথা হয়ে উঠেছিলো দেবকুল কি তা আগেভাগে টের পেয়েছিলয়? তাতে কি? গণেশতো হাতির মাথা নিয়েই প্রাণ ফিরে পেয়েছিলেন। আজ অবধি আমরা গণেশকে এইরূপেই দেবতা বলে জেনে এসেছি। না হয় এই জগতের প্রাণীকুলের আকার প্রকারগুলোতে বাহরাম সেঁটে দিলেন তাঁর চেতনা। চিনে বা জেনে ওঠার সময়তো দিতে হয়। তবেই অচেনাকে হবে চেনা। বাহরামতো তাঁর চেতনার ভেতর হারিয়ে নিজের রাস্তা চিনেছেন। আমাদের কেন নয়!

কবে প্রতিষ্ঠান আমাদের চেনা জানার সূচক নির্ধারন করে দিয়েছিল, তার ভেতর আবার ঝড় ওঠে এই সূচকের মাত্রা কতখানি সীমিত। যে এই সীমা অতিক্রম করে অথবা যে বা যারা এই সীমার ভেতর কখনো ছিলই না তারা ঝুঁকিপূর্ণ পথ ধরে চলতে থাকেন। এতে তেমন  কারো বারণ থাকে না এতে প্রায় বিচ্যুত বা বাতিল বা আগন্তুক হয়ে যাবার সম্ভাবনা থাকে।  বাহরাম প্রাতিষ্ঠানিক সীমার মধ্যে ছিলেন না। ১৯৫০ ঢাকায় জন্মেছিলেন সৈয়দ কোমার হোসেন সিরাজী ওরফে বাহরাম। তাঁর বাবার কাছে শুরু আঁকাআঁকি।  ভাই আব্দুলের সহযোগী হয়ে অল্প বয়সে রপ্ত করেন বেবিটেক্সি, রিকশা পেন্টিং এর কৌশল। ঘুরে বেড়াতেন ঢাকার নানা খ্যাতি সম্পন্ন স্টুডিওতে। সেখান থেকে আরো দক্ষ হয়ে  ওঠেন সিনেমার ব্যনার সহ জনপ্রিয় নায়ক নায়িকাদের প্রতিকৃতি অংকনে। সেই ষাটের দশকে সিনেমার পোষ্টার, সাইনবোর্ড, ব্যানার ষ্টুডিওর ব্যাকস্ক্রীনের এক ব্যস্ত অংকন শিল্পী হয়ে ওঠেন আর মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী রুজি রোজগারের জন্য সেই টেক্সিপেন্টিং করে জীবন অতিবাহিত করছিলেন। কিন্তু কী হবে এটুকু নিয়েএই ধরা বাধা বাণিজ্যিক কলাকারের বাইরে আরো কিছু খুঁজছিলেন। কিছুকাল শাড়ির নকশাও করেছিলেন।

সময় দ্রুত পাল্টে যায় সমান্তরালভাবে বদলে যায় চাহিদা আর প্রযুক্তি  নব্বই পর থেকে ধীরে ধীরে দেশের আরবান আর্ট খ্যাত রিক্সা, টেক্সি পেন্টিং এর চাহিদাটা কমতে থাকে। এমনকি বাংলা সিনেমার ইন্ডাস্ট্রিতেও সেই প্রভাব পড়ে।  সেই সিনেমা ব্যানারের জন্য আঁকিয়ের কদরও কমতে থাকে। এরপরও বাহরাম তাঁর পেশা পরিবর্তন করেননি। তবে এতদিনে তাঁর শিল্পপ্রতিভা সম্পর্কিত খবরাখবর কিছু কিছু মানুষের কাছে পৌঁছাতে থাকে। শূন্যর দশকের শুরুর দিকে বৃত্ত আর্ট ট্রাস্টের একটি  কর্মশালায় অংশ নিতে গিয়ে বাংলাদেশের শিল্পী মহলে পরিচিত হয়ে ওঠেন। তাঁর মনোযোগী,  নিখুঁত শিল্পগুণ আর বিস্ময়কর কল্পনা কোথায় যেন ধাক্কা দেয় বাংলাদেশের চলতি শিল্পচর্চায়। আলোচিত হয়ে ওঠেন বিদগ্ধ শিল্পপ্রেমী আর শিল্পসমালোচকদের মাঝে আর বাহরাম দাঁড় করালেন অদ্ভুত এক শিল্পভাষা। অর্জন করলেন আর্ট এন্ড বাংলাদেশ তথা ডেপ আর্টের শিল্পবৃত্তি যেখানে তিনি সূযোগ পান স্টুডিও ভিত্তিক শিল্পচর্চার স্বাধীনতা। কিন্তু এতদিনে তিনি অনেকটা ক্লান্ত, ভেঙে পড়েছে তাঁর শরীর  এর ভেতরেই তাঁর প্রথম এবং শেষ একক প্রদর্শণী অনুষ্ঠিত হয় ২০১৪তে তৎকালিন ঢাকা আর্ট সেণ্টারে এরপর থেকে শিল্পী প্রায় অসুস্থ, নীরব এবং শারীরিক অবস্থার দিন দিন অবনতি হতে থাকে। তাঁর খবরাখবর খুব একটা পাওয়া যেত না।  যে শিল্পীকে নিয়ে এত ভাবনা, এত আলোড়ন, তার নীরবতায় আমাদের কারো কি কোনো মনোযোগ আকর্ষণ করেনি টা বছর?     নিয়ে বাহরামের তেমন কোনো কথা ছিল কিনা জানা যায় না। তবে এর দায় থেকে যায় আমাদের শেষমেশ যা হল- বছরেই আগস্ট তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
     
বাহরামের শিল্পকর্ম সম্পর্কে দর্শক, শিল্পপ্রেমীদের অনেকের ধারণা হতে পারে সুররিয়ালিজম বা সালভাদর দালিদের কাছাকাছি কিছু একটার মত হবে কিন্তু তিনিতো ঐসব শিল্পোন্দোলনের ইতিহাসের ধারে কাছে কখনো ছিলেনই না। আর এসবের ভিতর উনি আসতেও চাইবেন না। বাহরাম ভালো করে এই পরিবেশ আর প্রকৃ্তির মাঝে নিজেকে দেখেছেন আর দেখেছেন মানুষকেও। বোধ করি দেখার ক্ষমতাই তাঁর শিল্পকে বিনির্মাণ করেছিল।  

বাহরামের ছবির মুখগুলো গোমরা, মাঝে মধ্যে এরা বিদ্রুপ ভঙ্গি বা অভিমানী দৃষ্টি ফেলে রাখে দর্শকের দৃষ্টির উপর আবার অনেকে তাকিয়ে থাকে সরলভাবে। বাঁকা ত্যারা হয়ে মুখায়ব গুলো হয় ওঠে কিম্ভুতকিমাকার কিছু একটা বলতে গিয়ে যেন বলা থেকে বিরত এরা। আর রঙ প্রয়োগে ফ্ল্যাট। কিন্তু বিষয়বস্তুর নির্মাণে নিখুঁত প্রতিটা মানুষের মুখ কোন না কোন পশু বা পাখির নিরীহ অবস্থান অথবা মানুষের শরীরের কোন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ  অথবা কোনো জড়বস্তুর অংশ মিলে হয় প্রতিকৃতির গঠন। ফর্মগুলো যেন তাঁকে বাধ্য করে তার গতি নির্ধারণে সতঃস্ফুর্ত রঙ লেপন আর রেখার টানে পুরো ছবিটা অদ্ভূত এক রূপ লাভ করে এভাবেইতো নীল বর্ণের উপরে রঙীন গোঁফওয়ালা চেহারা। রাজহংসের ডানার ঝাঁপে বাকানো একহাতের বৃদ্ধা আঙুল রূপান্তরিত হল খর্বাকৃতির লাল ফ্রক পরিহিতা এক নারী। এবার প্রতিকৃতির শুধু একচোখের এক নিস্পলক দৃষ্টি। বোধ হয় রাজহংস মুখে কিছু তুলে নিয়েছিলো বলেই এত কান্ড। এত প্রাণী মিলে মিশে একাকার। 

আবার কিছু ছবিতে শুধু পশুর নিরীহ অথবা রোমাঞ্চকর কোন মুহুর্ত প্রকাশ পায় যেখানে বন্যপ্রানীর প্রকৃতি সম্পর্কিত চিন্তা পারিপার্শ্বিক বিবেচনার বোধ ফুটে ওঠে   কাটা গাছের অংশে বানরের ক্ষুদ্র মাথা সংযুক্ত বিশালাকার বাঘটি মাথা বাঁকিয়ে কী যেন দেখছে আবার ছোট্ট দোয়েলটি পাতা শূন্য শুকনো গাছে দাড়িঁয়ে আছেএখানে পশু পাথির রঙগুলো অপরিবর্তিত, রঙগুলো চেনা যায়কিন্তু প্রায় এক রঙা ছিল এর ফ্ল্যাট ব্যাকগ্রাউন্ড। প্রানী গুলোকে দেখে মনে হয় ওরা বোধ হয় প্রকৃতির সেই চেনা রঙগুলোকে খুঁজছে। এও তাঁর শিল্পের বিশেষ ক্ষমতা যেখানে ইঙ্গিত পাওয়া যায় প্রকৃতি পরিবেশের  উপর সাম্প্রতিক বিপর্যয়ের কিঞ্চিৎ আভাস অদ্ভুতুরে সব ছবির ভেতর যেন কত কথাকে চেপে রেখেছে কল্পনার খেলায়! কথার খেলার পরিবর্তে কল্পনার খেলায় ডুবেছিলেন বাহরাম তাই হয়তো ছবিগুলো জেগে থাকে আর চাপা পড়ে যাওয়া কথাকে প্রকাশ করে প্রাণীকুলের সংমিশ্রিত সামঞ্জস্যে কিছু উদ্ভট ইঙ্গিতময় ভঙ্গিমায়

বাহরাম নিজের শিল্পকর্মকে সন্তানের সাথে তুলনা করতেন তাঁর দাবি ছবিগুলোর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে তাঁর যথেষ্ঠ ধারণা আছে। এই বিশ্বাস নিয়েই তিনি ঘুমিয়ে গেছেন। বাহরাম ঘুমিয়ে গেছেন, তাঁর ছবিগুলো জেগে আছে। সেই নিষ্পলদৃষ্টি রেখে আমাদের পাহাড়া দিচ্ছে আর মনে করিয়ে দিচ্ছে বাহরামের জনসন্মুখে বলা একটি উক্তি-
"আমার সন্তানের চরিত্র কি সেটা আমি বলতে পারব যদি ষোল আনা নাও পারি আটানা তো বলতে পারব।"
জেগে থাকুক বাহরামের ছবি।