Monday, August 8, 2016

শিল্প বিনির্মাণ এবং বাহরাম


পলাশ ভট্টাচার্য্য
Publication: 
http://www.banglanews24.com/art-literature/news/bd/508400.details
দুটো চোখ নিস্পলক। চোখ দুটির একটি আবার গরুর। আস্ত মানব প্রতিকৃতিতে আস্ত একটা গরু জায়গা করে নিলো। গরুটা ছিলো বলেই তো মনুষ্য চেহারাখানার আকার এলো। তারপর গলার কাছে  একটা হাত চেপে রাখা, ওটা গলাটিপে ধরার মত কিছু না, ওটা মোলায়েম ভাবে চেপে রাখা একটা হাত ওটা চেপে না ধরলে হয়তো একেক দিকে ছিটকে পড়বে অভাগা গরু আর মানুষটি। তখন  প্রতিকৃতিটি ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবার ঝুঁকি থেকে যাবে। কপাল ভালো সামঞ্জস্যের হাত খানা গলার কাছে ছিলো। না হলে যে কি হত!

কি আর হতো! যে যার রাস্তায় ছিল সেখানেই পড়ে থাকতো। বাহরাম এই জগতকে মিশিয়ে দিলেন উদ্ভট এক চেতনায়। লজিকের বাঁধা রাস্তা থেকে বিচ্যুত বাহরাম। এই জগত অবিশ্বাস্য কোনো  এক চেতনার ভেতর মিশে যেতে না যেতেই আবার সেই চেনা রাস্তাগুলো ফের উঁকি মারতে করে শুরু করে দেয়। তখন মনে হয় এই বুঝি সেই। এমনটা না হলেই কি নয়! শিবপুরাণে যে শনির দশায় গণেশের মাথাটা হাতির মাথা হয়ে উঠেছিলো দেবকুল কি তা আগেভাগে টের পেয়েছিলয়? তাতে কি? গণেশতো হাতির মাথা নিয়েই প্রাণ ফিরে পেয়েছিলেন। আজ অবধি আমরা গণেশকে এইরূপেই দেবতা বলে জেনে এসেছি। না হয় এই জগতের প্রাণীকুলের আকার প্রকারগুলোতে বাহরাম সেঁটে দিলেন তাঁর চেতনা। চিনে বা জেনে ওঠার সময়তো দিতে হয়। তবেই অচেনাকে হবে চেনা। বাহরামতো তাঁর চেতনার ভেতর হারিয়ে নিজের রাস্তা চিনেছেন। আমাদের কেন নয়!

কবে প্রতিষ্ঠান আমাদের চেনা জানার সূচক নির্ধারন করে দিয়েছিল, তার ভেতর আবার ঝড় ওঠে এই সূচকের মাত্রা কতখানি সীমিত। যে এই সীমা অতিক্রম করে অথবা যে বা যারা এই সীমার ভেতর কখনো ছিলই না তারা ঝুঁকিপূর্ণ পথ ধরে চলতে থাকেন। এতে তেমন  কারো বারণ থাকে না এতে প্রায় বিচ্যুত বা বাতিল বা আগন্তুক হয়ে যাবার সম্ভাবনা থাকে।  বাহরাম প্রাতিষ্ঠানিক সীমার মধ্যে ছিলেন না। ১৯৫০ ঢাকায় জন্মেছিলেন সৈয়দ কোমার হোসেন সিরাজী ওরফে বাহরাম। তাঁর বাবার কাছে শুরু আঁকাআঁকি।  ভাই আব্দুলের সহযোগী হয়ে অল্প বয়সে রপ্ত করেন বেবিটেক্সি, রিকশা পেন্টিং এর কৌশল। ঘুরে বেড়াতেন ঢাকার নানা খ্যাতি সম্পন্ন স্টুডিওতে। সেখান থেকে আরো দক্ষ হয়ে  ওঠেন সিনেমার ব্যনার সহ জনপ্রিয় নায়ক নায়িকাদের প্রতিকৃতি অংকনে। সেই ষাটের দশকে সিনেমার পোষ্টার, সাইনবোর্ড, ব্যানার ষ্টুডিওর ব্যাকস্ক্রীনের এক ব্যস্ত অংকন শিল্পী হয়ে ওঠেন আর মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী রুজি রোজগারের জন্য সেই টেক্সিপেন্টিং করে জীবন অতিবাহিত করছিলেন। কিন্তু কী হবে এটুকু নিয়েএই ধরা বাধা বাণিজ্যিক কলাকারের বাইরে আরো কিছু খুঁজছিলেন। কিছুকাল শাড়ির নকশাও করেছিলেন।

সময় দ্রুত পাল্টে যায় সমান্তরালভাবে বদলে যায় চাহিদা আর প্রযুক্তি  নব্বই পর থেকে ধীরে ধীরে দেশের আরবান আর্ট খ্যাত রিক্সা, টেক্সি পেন্টিং এর চাহিদাটা কমতে থাকে। এমনকি বাংলা সিনেমার ইন্ডাস্ট্রিতেও সেই প্রভাব পড়ে।  সেই সিনেমা ব্যানারের জন্য আঁকিয়ের কদরও কমতে থাকে। এরপরও বাহরাম তাঁর পেশা পরিবর্তন করেননি। তবে এতদিনে তাঁর শিল্পপ্রতিভা সম্পর্কিত খবরাখবর কিছু কিছু মানুষের কাছে পৌঁছাতে থাকে। শূন্যর দশকের শুরুর দিকে বৃত্ত আর্ট ট্রাস্টের একটি  কর্মশালায় অংশ নিতে গিয়ে বাংলাদেশের শিল্পী মহলে পরিচিত হয়ে ওঠেন। তাঁর মনোযোগী,  নিখুঁত শিল্পগুণ আর বিস্ময়কর কল্পনা কোথায় যেন ধাক্কা দেয় বাংলাদেশের চলতি শিল্পচর্চায়। আলোচিত হয়ে ওঠেন বিদগ্ধ শিল্পপ্রেমী আর শিল্পসমালোচকদের মাঝে আর বাহরাম দাঁড় করালেন অদ্ভুত এক শিল্পভাষা। অর্জন করলেন আর্ট এন্ড বাংলাদেশ তথা ডেপ আর্টের শিল্পবৃত্তি যেখানে তিনি সূযোগ পান স্টুডিও ভিত্তিক শিল্পচর্চার স্বাধীনতা। কিন্তু এতদিনে তিনি অনেকটা ক্লান্ত, ভেঙে পড়েছে তাঁর শরীর  এর ভেতরেই তাঁর প্রথম এবং শেষ একক প্রদর্শণী অনুষ্ঠিত হয় ২০১৪তে তৎকালিন ঢাকা আর্ট সেণ্টারে এরপর থেকে শিল্পী প্রায় অসুস্থ, নীরব এবং শারীরিক অবস্থার দিন দিন অবনতি হতে থাকে। তাঁর খবরাখবর খুব একটা পাওয়া যেত না।  যে শিল্পীকে নিয়ে এত ভাবনা, এত আলোড়ন, তার নীরবতায় আমাদের কারো কি কোনো মনোযোগ আকর্ষণ করেনি টা বছর?     নিয়ে বাহরামের তেমন কোনো কথা ছিল কিনা জানা যায় না। তবে এর দায় থেকে যায় আমাদের শেষমেশ যা হল- বছরেই আগস্ট তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
     
বাহরামের শিল্পকর্ম সম্পর্কে দর্শক, শিল্পপ্রেমীদের অনেকের ধারণা হতে পারে সুররিয়ালিজম বা সালভাদর দালিদের কাছাকাছি কিছু একটার মত হবে কিন্তু তিনিতো ঐসব শিল্পোন্দোলনের ইতিহাসের ধারে কাছে কখনো ছিলেনই না। আর এসবের ভিতর উনি আসতেও চাইবেন না। বাহরাম ভালো করে এই পরিবেশ আর প্রকৃ্তির মাঝে নিজেকে দেখেছেন আর দেখেছেন মানুষকেও। বোধ করি দেখার ক্ষমতাই তাঁর শিল্পকে বিনির্মাণ করেছিল।  

বাহরামের ছবির মুখগুলো গোমরা, মাঝে মধ্যে এরা বিদ্রুপ ভঙ্গি বা অভিমানী দৃষ্টি ফেলে রাখে দর্শকের দৃষ্টির উপর আবার অনেকে তাকিয়ে থাকে সরলভাবে। বাঁকা ত্যারা হয়ে মুখায়ব গুলো হয় ওঠে কিম্ভুতকিমাকার কিছু একটা বলতে গিয়ে যেন বলা থেকে বিরত এরা। আর রঙ প্রয়োগে ফ্ল্যাট। কিন্তু বিষয়বস্তুর নির্মাণে নিখুঁত প্রতিটা মানুষের মুখ কোন না কোন পশু বা পাখির নিরীহ অবস্থান অথবা মানুষের শরীরের কোন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ  অথবা কোনো জড়বস্তুর অংশ মিলে হয় প্রতিকৃতির গঠন। ফর্মগুলো যেন তাঁকে বাধ্য করে তার গতি নির্ধারণে সতঃস্ফুর্ত রঙ লেপন আর রেখার টানে পুরো ছবিটা অদ্ভূত এক রূপ লাভ করে এভাবেইতো নীল বর্ণের উপরে রঙীন গোঁফওয়ালা চেহারা। রাজহংসের ডানার ঝাঁপে বাকানো একহাতের বৃদ্ধা আঙুল রূপান্তরিত হল খর্বাকৃতির লাল ফ্রক পরিহিতা এক নারী। এবার প্রতিকৃতির শুধু একচোখের এক নিস্পলক দৃষ্টি। বোধ হয় রাজহংস মুখে কিছু তুলে নিয়েছিলো বলেই এত কান্ড। এত প্রাণী মিলে মিশে একাকার। 

আবার কিছু ছবিতে শুধু পশুর নিরীহ অথবা রোমাঞ্চকর কোন মুহুর্ত প্রকাশ পায় যেখানে বন্যপ্রানীর প্রকৃতি সম্পর্কিত চিন্তা পারিপার্শ্বিক বিবেচনার বোধ ফুটে ওঠে   কাটা গাছের অংশে বানরের ক্ষুদ্র মাথা সংযুক্ত বিশালাকার বাঘটি মাথা বাঁকিয়ে কী যেন দেখছে আবার ছোট্ট দোয়েলটি পাতা শূন্য শুকনো গাছে দাড়িঁয়ে আছেএখানে পশু পাথির রঙগুলো অপরিবর্তিত, রঙগুলো চেনা যায়কিন্তু প্রায় এক রঙা ছিল এর ফ্ল্যাট ব্যাকগ্রাউন্ড। প্রানী গুলোকে দেখে মনে হয় ওরা বোধ হয় প্রকৃতির সেই চেনা রঙগুলোকে খুঁজছে। এও তাঁর শিল্পের বিশেষ ক্ষমতা যেখানে ইঙ্গিত পাওয়া যায় প্রকৃতি পরিবেশের  উপর সাম্প্রতিক বিপর্যয়ের কিঞ্চিৎ আভাস অদ্ভুতুরে সব ছবির ভেতর যেন কত কথাকে চেপে রেখেছে কল্পনার খেলায়! কথার খেলার পরিবর্তে কল্পনার খেলায় ডুবেছিলেন বাহরাম তাই হয়তো ছবিগুলো জেগে থাকে আর চাপা পড়ে যাওয়া কথাকে প্রকাশ করে প্রাণীকুলের সংমিশ্রিত সামঞ্জস্যে কিছু উদ্ভট ইঙ্গিতময় ভঙ্গিমায়

বাহরাম নিজের শিল্পকর্মকে সন্তানের সাথে তুলনা করতেন তাঁর দাবি ছবিগুলোর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে তাঁর যথেষ্ঠ ধারণা আছে। এই বিশ্বাস নিয়েই তিনি ঘুমিয়ে গেছেন। বাহরাম ঘুমিয়ে গেছেন, তাঁর ছবিগুলো জেগে আছে। সেই নিষ্পলদৃষ্টি রেখে আমাদের পাহাড়া দিচ্ছে আর মনে করিয়ে দিচ্ছে বাহরামের জনসন্মুখে বলা একটি উক্তি-
"আমার সন্তানের চরিত্র কি সেটা আমি বলতে পারব যদি ষোল আনা নাও পারি আটানা তো বলতে পারব।"
জেগে থাকুক বাহরামের ছবি।