Saturday, August 5, 2017

রিপন সাহা'র নির্ঘুম স্বপ্ন সাম্রাজ্য


পলাশ ভট্টাচার্য্য
Publication:  'The Empire of Dream' Ripon Saha's solo exhibition Catalogue, Kalakendra, Dhaka.

নির্ঘুম স্বপ্ন সাম্রাজ্য- রঙ বেরঙের স্থির আর অস্থির দৃশ্য। প্রতিটি দৃশ্য আর দৃশ্যগুচ্ছের আমেজ কখনো উৎসবে অথবা আয়েশে, কখনো বিদ্রুপে অথবা কটাক্ষে আর কখনো সংঘাতে কিংবা নৈরাজ্যে। এইসব নির্ঘুম স্বপ্নকল্পে ছুটে বেড়ানোর সমূহ চিত্র নিয়ে রিপন সাহার এবারের প্রকল্প The Empire of Dream.

রিপনের শৈশব হতে আজ অব্দি বেড়ে ওঠা চট্টগ্রামের হাজারী লেন সংলগ্ন এলাকায়। যার আশপাশটা জুড়ে রয়েছে থানা, কোর্ট, স্কুল, হোটেল, ময়দান, মার্কেট, সিনেমা হল থেকে শুরু করে ধর্মীয় উপাসনালয়। আর খুব কাছেই বয়ে গেছে কর্ণফুলী নদী। এলাকাকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় যেসব ঘটনা- তা উৎসব থেকে শুরু করে সংঘর্ষ পর্যন্ত বিস্তৃত। এসব ঘটনার সাথে যাদের সম্পর্ক , রিপন তাদের কখনো দেখেছে দূর থেকে আবার কখনো খুব কাছ থেকেই চিনেছে। এই বেড়ে ওঠার বিচিত্র সব অভিজ্ঞতার সঞ্চয়গুলো জারিত হয়ে ভিন্ন কোন জগতের ব্যাপকতায় বিচরণ রিপনের। শৃংখলার বাইরে ছিটকে স্থানিক, বৈশ্বিক এবং সার্বজনীনতার স্বতস্ফুর্ত সম্পর্ক গড়ে ওঠে কখনো সামজিক জমকালো উৎসবের সাথে, কখনো বিবর্ণ বিক্ষিপ্ত নৈরাজ্যের সাথে, আবার কখনো প্রকৃতির সাথে।

রিপনের স্বপ্ন যে নৈরাজ্যে পর্যবসিত হয়, সেখানে রয়েছে একদিকে তীব্র হানাহানি, আরেকদিকে বিদ্রুপ আর কটাক্ষের স্নায়বিক উত্তেজনা। এসব হানাহানির ভেতর জায়গা করে নিয়েছে স্থানীয় রূপকথা, মিথ আর জনপ্রিয় প্রবাদ। এই উত্তেজনার রাজনৈতিক অথবা মতাদর্শিক কোনো পর্যায়ে সমাধান নেই। আছে নানা পর্যায়ের ক্ষমতার দৃষ্টান্ত যেখানে সাংঘর্ষিক মৃত্যুর  চেয়েও রয়েছে শক্তির চমক । নীৎশের মতে যেমনটা That which does not kill us makes us stronger.    রিপন এই ক্ষীপ্রতার বিন্যাসে বের করে আনে কালো লালে'র আধিক্যে ছোট ছোট ক্যানভাসের একগুচ্ছ চিত্র যেখানে উঠে আসে সংঘর্ষের সংস্কৃতি।

অর্থনৈতিক মানদন্ডের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা ক্ষমতাকে নিয়ে  চটুল সেসব শ্রেণীকে বার বার উপস্থাপন করা হয়েছে বিদ্রুপ আর কটাক্ষের অভিনব আঙ্গিকে। যেখানে অনেক চিত্রে ঘুরে ফিরে মানব দেহের গঠন হয়ে উঠেছে আঙ্গুল সর্বস্ব। আঙ্গুলের নির্দেশ, আঙ্গুলের ভঙ্গিগুলো যেন ক্ষমতার উত্থানের অনুমাপক। তাছাড়া জমকালো সামাজিক উৎসব নিয়েও বাহাস করার প্রবণতা দেখা যায় গুচ্ছ গুচ্ছ আলোচ্ছ্বটায় কোলাহলমুখর শহরের চমক সৃষ্টি করা চিত্রগুলোতে।

এই সমসÍ উদবেগের ভেতর রিপনের ফ্যান্টাসি লক্ষ্য করা যায় প্রকৃতির সাথে কৌতুকাবহে গড়ে ওঠা তার ব্যক্তিগত সম্পর্কে। নদীতে ভাসানো অংক খাতার কাগজের নৌকায় বাঘের সাথে সাক্ষাত কিংবা টুকরো টুকরো সাদা ভাসমান মেঘের সাথে নিত্য ব্যবহৃত সাধারণ কোন বস্তুর উপস্থিতিতে গড়ে ওঠা সিনেমাটিক ফ্যান্টাসি যা জাগতিক অভিজ্ঞানের ভেতর অবদমিত প্রতিচ্ছবি। এছাড়া হিসেবের খাতার নৌকা যেন একেবারেই মানুষে মানুষে পরিপূর্ণ, কেউ কেউ নদীতে ঝাঁপিয়ে বা ডুবসাঁতার দিয়ে পাড়ি দিচ্ছে কোথাও। স্থানচ্যুত মানবগোষ্ঠী কোন অজানায় পাড়ি দিয়ে যাচ্ছে- যা গোটা বিশ্বের রাজনৈতিক ক্ষমতার সৃষ্টি এক কৃত্রিম সঙ্কটের প্রতি ইংগিত প্রকাশ করেছে রিপন।

ইতিপূর্বে রিপনের একক প্রদর্শনীর শিল্পকর্মগুলোতে স্টেন্সিল আর স্প্রে কালারের ফিগারিটিভ বিন্যাস লক্ষ্য করা গেলেও এ পর্যায়ে স্টেন্সিলের ব্যবহার তেমন নেই বললেই চলে। এখানে রয়েছে ফিগারেটিভ ফর্ম, রেখা আর রঙের আধিক্য। মানব আকারের কখনো ঘটেছে বিকার কিংবা রূপান্তরিত আকার- যেমন আঙ্গুল সর্বস্বতা এ পর্যায়ের একটি প্রধান মেটাফরিক উপাদান। উপকরণের মধ্যে রয়েছে এক্রেলিক পেন, এক্রেলিক কালারস্প্রে কালার, প্রেস ইংক প্রভৃতির ব্যবহার। পাশাপাশি রয়েছে কিছু এনিমেটেড ভিডিও চিত্র। ম্যানুয়াল আর ডিজিটাল উভয় প্রক্রিয়ায় নির্মিত ভিডিওগুলোতেও রয়েছে সংঘর্ষের সংস্কৃতি তথা অস্ত্র, রক্তপাত আর এর উৎসের বিপন্ন ইতিহাসের বিনির্মাণ।

রিপনের শিল্পচর্চার এ যাত্রা শুধু কৌশলগত দক্ষতার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। এই পরিক্রমণ  বুদ্ধিবৃত্তিক এবং ব্যক্তিগত জীবনযাপনের অভিজ্ঞতাগুলো তাকে নতুন পথের সন্ধানে অণুপ্রাণিত করে। তাই এই পথ হয়তো শুধু রাজনীতির কবলে আক্রান্ত নয়, তার চারপাশটায় আরো কিছু সংযোজন আর বিয়োজনের ভেতর ঘুরপাক খেতে থাকে অনেক কাল থেকে। এর ভেতরেই অভিজ্ঞতার বিনির্মাণ ঘটতে থাকে আর আত্মোপলব্ধি হতে থাকে জীবনভর। পাওলো ফ্রেইরির একটি কথা দিয়েই ইতি টানা যায় এ পর্যায়ে- No one is born fully-formed: it is through self-experience in the world that we become what we are.